ধীরে খেলে কি স্ট্রেস কমে? জানালেন গাঁট বিশেষজ্ঞরা

যে দ্রুতগতির পৃথিবীতে আমরা বাস করি, সেখানে খাওয়ার জন্য সময়-ই বা কার আছে? সবাই ছুটছে কোথাও পৌঁছাতে, কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে, বা নিজের আশপাশের মানুষদের চেয়ে আরো সফল হতে। এই দৌড়ঝাঁপের মাঝে আমরা অনেক সময় খাবারদাবার বাদ দিয়ে দিই, কিংবা এত দ্রুত খেয়ে ফেলি যে তা কয়েক মিনিটে খাবার গিলে ফেলার মতোই  হয়ে যায়। কাজের চাপ এত বেশি যে প্লেটে কী আছে, তা উপভোগ করার সময়ও থাকে না।

দ্রুত খাওয়া সময় বাঁচালেও এর বেশ কিছু অসুবিধা আছে।

স্কুল-জীবনে আমরা পড়েছি, খাবার ২০–৩২ বার চিবাতে হয়। কিন্তু এই ব্যস্ত জীবনে তা যেন কাজের তালিকা থেকে আরেকটি কাজ সেরে ফেলার মতোই হয়ে গেছে।

গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ডা. বিমল কুমার সাহু বলেন, ‘যখন আপনি দ্রুত খান, খাবার বড় বড় টুকরো হয়ে পেটে যায়। যার ফলে হজম অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

এতে গ্যাস হয়, এনজাইমের কাজ ধীর হয়ে যায় এবং গাঁট–ব্রেইন যোগাযোগেও ব্যাঘাত ঘটে।’তিনি আরো বলেন, ‘ধীরে খেলে খাবার মুখে বেশি সময় থাকে, ফলে সঠিকভাবে চিবানো হয় এবং লালা খাবারের সঙ্গে ভালোভাবে মেশে। এতে পেট ভালোভাবে কাজ করতে পারে এবং হজম এনজাইমের সঙ্গে খাবার সঠিকভাবে মিশে।’

এই বিশেষজ্ঞ আরো জানান, ধীরে খাওয়া গাটকে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠানোর সময় দেয়, যা ভেগাস নার্ভের মাধ্যমে ঘটে।এটি ক্ষুধা ও তৃপ্তি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

ধীরে খাওয়া কিভাবে এসিডিটি ও হজমের সমস্যায় উপকার করে

ডা. ভূষণ ভোলে বলেন, ‘ধীরে খেলে স্বাভাবিকভাবেই কম বাতাস ঢোকে, যা ফোলাভাব কমায়। সঠিকভাবে চিবানো খাবার দ্রুত হজমে সাহায্য করে এবং অন্ত্রে ফারমেন্টেশন প্রতিরোধ করে। আর এই ফারমেন্টেশনই গ্যাসের কারণ।’

পেট ভরে গেলে অতিরিক্ত এসিড ওপরে উঠে ইসোফেগাসে যাওয়ার ঝুঁকিও কমে, ফলে হর্টবার্ন বা বুকজ্বালার সমস্যা কমে।

খাওয়ার গতি ও গাঁট–ব্রেইন অ্যাক্সিসের সম্পর্ক

আমরা অনেকেই জানি না, মস্তিষ্ক ও অন্ত্রের মধ্যে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থার নাম গাঁট-ব্রেইন অ্যাক্সিস। এটি এন্ডোক্রাইন (হরমোন), নার্ভাস ও ইমিউন সিস্টেম নিয়ে গঠিত। ডা. সাহু বলেন, ‘ধীরে খেলে গাঁট-ব্রেইন অ্যাক্সিসে প্রভাব পড়ে। এতে জিএলপি-১ ও পিওয়াইওয়াই–এর মতো তৃপ্তি-হরমোন স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।’

এই হরমোনগুলো মস্তিষ্ককে জানায় যে আপনার পেট ভরে গেছে। ফলে অতিভোজন কমে। ধীরে খেলে ক্ষুধা-হরমোন ঘ্রেলিনও ধীরে ধীরে কমে। যখন দ্রুত খাওয়া হয়, এই সংকেতগুলো সঠিকভাবে পৌঁছায় না। ফলে মস্তিষ্ক ‘পেট ভরে গেছে’ বার্তা সময়মতো পায় না, এতে অতিরিক্ত খাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

ধীরে খেলে কি স্ট্রেস কমে?

আপনি যদি নিয়মিত কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, পেটব্যথা, ফোলাভাব ইত্যাদিতে ভোগেন, তবে ধীরে খাওয়া হতে পারে উপেক্ষিত সমাধান। ডা. ভোলে বলেন, ‘আইবিএস বা ফাংশনাল ডিসপেপসিয়া রোগীদের জন্য ধীরে খাওয়া খুব উপকারী। দ্রুত খেলে গাঁট অতিরিক্ত উদ্দীপিত হয়। কিন্তু ধীরে খেলে গাটের চাপ কমে, খাবার সহজে অগ্রসর হয় এবং বাতাস গেলার প্রবণতা ও অতিভোজন কমে।’

তিনি আরো বলেন, ধীরে খাওয়া মানেই মাইন্ডফুল ইটিং, যা স্ট্রেস কমায়। স্ট্রেস আইবিএস বাড়ানোর বড় কারণ, তাই ধীরে খাওয়া উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে।

কত ধীরে খাওয়া উচিত

ডা. ভোলে বলেন, ‘কঠোর নিয়ম নেই, তবে গাঁট-ব্রেইন অ্যাক্সিস সক্রিয় হতে ১৫–২০ মিনিট লাগে। অন্তত এই সময় নিয়ে খেলে শরীর বুঝতে পারে আপনি তৃপ্ত।’

ডা. সাহু জানান, এই সময় ধরে খেলে অপ্রয়োজনীয় স্ন্যাকিং বা অতিভোজন কমে।

যদি ১০ মিনিটের কম সময়ে খাবার শেষ করেন, তবে মস্তিষ্ক তৃপ্তির সংকেত পায় না। এতে অতিরিক্ত ক্যালরি খাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং পেটের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মাইন্ডফুল ইটিং টেকনিক

এই পদ্ধতিতে খেলে গাঁট হেলথ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ডা. সাহুর পরামর্শ দেন, প্রতিটি কামড় ২০–৩০ বার চিবাতে হবে। প্রতি কামড়ের পর চামচ-কাঁটা নামিয়ে একটু বিরতি নিন। এই সময়ে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন, খাবারের আগে গভীর শ্বাস নিন এবং ছোট অংশ দিয়ে শুরু করুন। এ ছাড়া শান্ত পরিবেশে খাবার খাওয়া এবং পানি ছোট চুমুকে পান করা উচিত।

এই দ্রুতগতির জীবনে স্ট্রেস অবশ্যম্ভাবী। তবে আপনার গাটকে এর চাপ নিতে হবে না। খাবারের স্বাদ নেওয়ার জন্য এবং শরীরকে পুষ্টি শোষণের সময় দেওয়ার জন্য প্রতিটি খাবারের জন্য অন্তত ৩০ মিনিট বের করুন।