এমপি-মন্ত্রীর ‘স্বজন’ নিয়ে জটিলতা আওয়ামী লীগে

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা। এ বিষয়ে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বানের পাশাপাশি নির্দেশনা না মানলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন তারা।

তৈরি করছেন তালিকাও। তবে দলের কঠোর অবস্থানের পরও নির্বাচন থেকে সরতে নারাজ অনেকেই। তারা সামনে আনছেন নানা যুক্তি। কেউ বলছেন, স্বজন বলতে শুধু পরিবারের সদস্য বোঝানো হয়েছে। আবার কারও দাবি-তারা এমপি-মন্ত্রীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এছাড়া অনেকেই আছেন যারা আগেও জনপ্রতিনিধি এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন বা আছেন।

এমন পরিস্থিতিতে এমপি-মন্ত্রীর ‘স্বজন’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় তৈরি হয়েছে জটিলতা। আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও স্বজনের ব্যাখ্যা এবং নিকটাত্মীয়তার সীমা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতের কথা জানিয়েছেন। কেউ বলছেন-স্বজন বলতে সন্তান, স্ত্রী, ভাই, বোন, ভগ্নিপতি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে।

আবার কারও কারও মতে, আত্মীয়স্বজন বলতে প্রথমত বোঝায় ‘ফাস্ট ব্লাড’ অর্থাৎ ছেলেমেয়ে, স্ত্রী এবং ভাইবোন। আবার কেউ বলছেন, সবকিছুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায় না। নির্বাচন নিয়ে তাদের দলের মূল যে স্পিরিট-নির্বাচনে যেন কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই কাজ করছেন তারা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এমপি  বলেন, এই বিষয়গুলো (এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের তালিকা তৈরি ও তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো) নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। সোমবার পর্যন্ত তো সময় আছে, দেখি কে কি করে। স্বজনের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অফিশিয়াল ব্যাখ্যাটা আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক সাহেব দেবেন। আমি মনে করি-স্বজন বলতে ছেলে হতে পারেন, ভাগনে-ভাতিজা হতে পারেন বা অন্য আত্মীয়ও হতে পারেন। এগুলো নিয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। আমরা আসলে চাইছি নির্বাচনে যেন কেউ কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন।

আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, স্বজন বলতে সন্তান, স্ত্রী, ভাই, শ্যালক, বোন, ভগ্নিপতি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। তবে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে আছেন এবং বর্তমানে জনপ্রতিনিধি আছেন এমনদের ক্ষেত্রে বিষয়টি শিথিলযোগ্য। মূলত তৃণমূলের ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যেন বঞ্চিত না হন, তারা যেন ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে নির্বাচনি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান এবং কোথায় যেন পরিবারতন্ত্রের আড়ালে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন  বলেন, আমরা এই নির্বাচনের সৌন্দর্যটা রক্ষা করতে চাই। নির্বাচনে আমাদের জনপ্রতিনিধি অনেকেই তার প্রার্থী ঘোষণা করার চেষ্টা করছেন, নির্বাচনে নেমে যাচ্ছেন। তখন কিন্তু নিয়ে অনেকে বিব্রত হন। ফলে সেই ধরনের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয় তার জন্য আগাম সতর্কতা হিসাবে এই কাজটি করছি। আমাদের দলের নেতারাও বিষয়টি মেনে নেবে বলেই আমি মনে করি। কারণ তারাও তো এই দলের লোক। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে যেন কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। ফলে এখানে যাকে যাকে আমরা মনে করব প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, আমরা সেই পর্যন্তই যাব। কারণ আমরা চাই-নির্বাচনটা যেন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হয়।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, কিছু কিছু সংজ্ঞা নিয়ে তো আসলে একাডেমিক আলোচনা করা যায় না। এখানে দেখতে হবে স্পিরিটটা কি সেটা বুঝতে হবে। বিষয়টা হলো এমপি-মন্ত্রীরা নির্বাচনে কারও পক্ষে সরাসরি নামতে পারবেন না। আর আত্মীয়স্বজন বলতে যেটা বোঝায়, প্রথমত তো ‘ফাস্ট ব্লাড’। অর্থাৎ ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ভাইবোন এগুলো। আর তাদের একেবারে নিকটজন। নিকটজন বলতে ব্লাড রিলেশন না হলেও তার খুব পছন্দের মানুষ। তার একেবারে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। এগুলো তো একেক জায়গায় একেক রকম হতে পারে। সব জায়গায় একই রকম হবে, বিষয়টা এমন নয়।

তিনি আরও বলেন, মূলত স্পিরিটটা হচ্ছে এমপি-মন্ত্রীরা যেন কোনো ভাবেই নির্বাচন প্রভাবিত করতে না পারেন। তারা নিরপেক্ষ থাকবেন, সাধারণ মানুষ ভোট দেবেন। বিরোধী দল বিভিন্নভাবে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করছে। আমরা চাই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থেকে বের হয়ে আসতে। সেই জায়গা থেকে সবাই দলের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা মেনে নেবেন বলে আশা করি। যারা এই সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন, সেই তালিকা আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে সেভাবে সেখানেই দিয়ে দেব।

মূলত উপজেলা পর্যায়ের নিজেদের ক্ষমতার বলয় ধরে রাখতে মরিয়া স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীরা। ফলে শুরু থেকেই নানা ভাবে এই নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামেন তারা। প্রার্থিতা প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ, প্রচারণা ও মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া, প্রার্থীকে অপহরণসহ নানা অভিযোগ উঠে বেশ কয়েকজন স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে।

এছাড়া অনেক এমপি-মন্ত্রী তাদের আত্মীয়স্বজনকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দাঁড় করান। সেই তালিকায় আছে-সন্তান, আপন ভাই, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, চাচা, শ্যালকসহ নানা ধরনের আত্মীয়স্বজন। এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর নির্দেশনা দেন-এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা প্রার্থী হতে পারবেন না। যারা ইতোমধ্যে নির্বাচনি মাঠে নেমেছেন তাদের সরে দাঁড়াতে বলা হয়।

এমন নির্দেশনার পরে কাজও শুরু করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার। এমপি-মন্ত্রীর ‘স্বজন’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় তৈরি হয়েছে জটিলতা। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মুরাদ কবীর। তিনি গাজীপুর-১ আসনের সংসদ-সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভাতিজা। মুরাদ কবীর বলেন, এমপি মন্ত্রীর স্বজন বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানি না। আমি মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীর মামাতো ভাইয়ের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। সারা বছর আওয়ামী লীগ করলাম এখন নির্বাচন করতে পারব না, এটা কেমন কথা?

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন ইসরাফিল আলম। তিনি স্থানীয় সংসদ-সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসরাফিল আলম বলেন, জাহিদ মালেক রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই আমি রাজনীতি করি। আর আমি পরপর দুবারের উপজেলা চেয়ারম্যান। জনগণের সমর্থন নিয়েই আমি নির্বাচন করছি। আমার নির্বাচন করতে পার্টি থেকে কোনো বাধা আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আত্মীয়স্বজন বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়নি। সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

এবার চার পর্বে উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। প্রথম পর্বে ১৫০টি উপজেলায় ভোট হবে ৮ মে। প্রথম পর্বের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন আজ। প্রথম পর্বের নির্বাচনে এখনো পর্যন্ত মাঠে আছেন বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়। আওয়ামী লীগের নির্দেশনা মানতে আজকের মধ্যেই তাদের দলীয় মনোনয়ন ফরম প্রত্যহার করতে হবে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছে, এই নির্দেশনা চার ধাপের নির্বাচনের জন্যই প্রযোজ্য।