বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে খেলাপি ঋণ ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিকে উদ্বেগজনক হিসাবে অভিহিত করেছে। একই সঙ্গে তারা বলেছে, মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরি বাড়ার হার অনেক কম। এতে ভোক্তার আয় কমেছে। ফলে তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। অন্যান্য খাতের তুলনায় শিল্প খাতের কর্মীদের মজুরি সবচেয়ে কম বেড়েছে। এতে শিল্প খাতে উৎপাদন কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে এখনো কিছুটা অস্থিরতা রয়েছে। তবে তা আগের চেয়ে কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪ অক্টোবর প্রকাশ করেছে। কিন্তু এটি এতদিন কারিগরি ত্রুটির জন্য খোলা যায়নি। বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি ডাউনলোড করা সম্ভব হয়েছে।
প্রতিবেদনে সার্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরের দিকে তাকিয়ে আছে। এ বছরে দেশে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি হতে পারে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। এর সুফল অর্থনীতিতে আসছে। একই সঙ্গে রাজস্ব ও আর্থিক খাতে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবহণ ও জ্বালানি খাতের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তাবায়ন হলে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বেড়েছে রেকর্ড হারে। ২০২১ সালের জুনে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশে। গত জুনে তা আরও বেড়ে ডাবল ডিজিটে অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ গত জুনে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশে। খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দায় ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়াকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্বেগজনক হিসাবে মনে করছে।
প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণখেলাপিদের নিবিড় তদারকির মধ্যে রাখার কথা বলেছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সমস্যাকবলিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে ঋণ আদায় বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে অভ্যন্তরীণভাবে নিবিড় তদারকি বাড়াতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শন ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। এছাড়া সমস্যাকবলতি ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নতুন নীতিমালা তৈরি করছে।
প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) নামে এই নীতিমালাটির আওতায় ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন অনুপাত, সম্পদের গুণগত মান ও লাভজনকের একটি সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। এটি যখন সীমার নিচে চলে যাবে তখন ওই ব্যাংককে এই নীতিমালার আওতায় বিশেষ ব্যবস্থায় তদারকি করা হবে। নীতিমালাটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। অচিরেই এটি জারি করা হবে। এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ দেওয়া হবে।
ইতোমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) সে দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তদারকি করতে এমন একটি নীতিমালা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি ও খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি দুটোই উদ্বেগজনক এতে কোনো সন্দেহ নেই। মূল্যস্ফীতির কারণে পুরো অর্থনীতি এলোমেলো হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে মূলত দুটি কারণে। একটি ডলারের দাম বৃদ্ধি ও দুই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি। ডলার বাজার ঠিক রাখতে পারলে ও বাজারে সঠিক তদারকি হলে মূল্যস্ফীতির হার এতটা বাড়ত না। কিন্তু প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি। এছাড়া অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় টাকা ছাড়িয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে গেছে। টাকা ছাড়ানো, ডলারের দাম ও উৎপাদন খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর ও সতর্ক দৃষ্টি রাখলে এ হার নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
তিনি বলেন, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশসহ বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দামও কমছে। কিন্তু দেশে এ হার কমছে না।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকে যেসব জালজালিয়াতি হয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। কারণ জালজালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ঋণের প্রায় পুরোটাই এখন খেলাপি হয়ে গেছে। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বাড়ছে তা উদ্বেগের বিষয়। এ হার গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত মে মাসে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।