দুর্নীতিবাজদের ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ দুদকের

দুর্নীতিবাজদের ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর অংশ হিসাবে শুরু হয়েছে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম। দুদকের দুটি টিম গত সপ্তাহ থেকে স্পর্শকাতর দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে জড়িতদের নাম-ঠিকানা এবং তাদের দুর্নীতি ও অপকর্মের ফিরিস্তি সংগ্রহ করছে। এ তালিকায় রাজনীতিবিদ, সাবেক ও বর্তমান দুর্নীতিবাজ আমলা, বিচারক, মেয়র, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী এবং রাষ্ট্রের অর্থ তছরুপের সঙ্গে জড়িদের নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

দুর্নীতিবাজদের ডেটাবেজ তৈরির ক্ষেত্রে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চেয়ে শক্তিশালী যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে দুদক টিম। ল্যাবের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২ হাজার বর্গফুটের একটি বিশেষ নিরাপদ কক্ষ ব্যবহার করছে টিম। এই ল্যাবের জন্য উন্নত দেশ থেকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও কানাডা থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও আনা হয়েছে।

এদিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে নানা ধরনের দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও জালজালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে জোরেশোরে শুরু হয়েছে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম। প্রায় দুই বছর টানা গবেষণার পর দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল সংযুক্ত করা হয় এই ল্যাব পরিচালনায়।

ডিভাইস ব্যবহার করে মানি লন্ডারিং ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের পাঁচটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা এরই মধ্যে শনাক্ত করেছেন টিমের সদ্যরা। সেই সঙ্গে ওই ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। এ তালিকায় দুটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তার নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান  বলেন, দুর্নীতিবাজদের ধরার জন্য আমরা তথ্যপ্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছি। আমাদের ফরেনসিক ল্যাবের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই ল্যাবের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ-অপরাধীদের ডেটাবেজের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এজন্য আমাদের দক্ষ টিম কাজ করছে। তারা প্রয়োজনীয় ট্রেনিং নিয়েছে। এখন সেই ট্রেনিং বাস্তবে কাজে লাগানোর জন্য মাঠ পর্যয়ে তারা কাজ করছেন।

জানা যায়, দুদকের পরিচালক রাজিব হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি টিম যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ কয়েকটি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের গোয়েন্দাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। দুদকের এ কাজে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) এবং ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। তাদের কাছ থেকে দুদক টিম কারিগরি সহায়তাও পাচ্ছে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কীভাবে দুর্নীতিবাজদের ডেটাবেজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনে, এ বিষয়ে দুদকের বিশেষ টিমের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দুদক এসব সংস্থার আদলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করেছে।

জানা যায়, জাল পাসপোর্ট, জাল এনআইডি, ব্যাংকের চেক জালিয়াতি, ঋণের জন্য জাল ডকুমেন্ট তৈরি, জাল বিদেশি মুদ্রা, স্বাক্ষর জালিয়াতি, ভয়েস রেকর্ড, ভিডিও ক্লিপ, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় দুর্নীতিসংক্রন্ত তথ্য আদান-প্রদান, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের অন্যান্য ভার্সন ব্যবহার করে দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। এক্ষেত্রে জড়িতদের চিহ্নিত করতে ফরেনসিক ল্যাব ব্যবহার করছে দুদক। কারও কণ্ঠ আসল না নকল, তা শনাক্ত করা যায় ফরেনসিক ল্যাবে। ঘুস লেনদেনসংক্রান্ত কথোপকথন ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধীকে শনাক্ত করার কাজ চলছে। ড্রোনেরও ফরেনসিক পরীক্ষা সম্ভব সংস্থাটির ডিজিটাল ল্যাবে। শুধু তাই নয়, দুদকের ফরেনসিক টেকনোলজি এতই উন্নত যে, কোনো সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের ভয়েস রেকর্ড গোপনে সংগ্রহ করতে পারে ফরেনসিক টিম।

সূত্র জানায়, এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে জালজালিয়াতি ও ডিজিটাল কারচুপির পৃথক ৫টি কেস হাতে নিয়েছে দুদক টিম। এর মধ্যে একটি হলো-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিএডিসির রেজিস্ট্রার স্টকে বীজের তথ্য উল্লেখ না করা সংক্রান্ত অভিযোগ। প্রযুক্তির সহযোগিতায় দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া ওই কর্মকর্তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছে দুদকের বিশেষ টিম। টিমের সদস্যরা এ সংক্রান্ত যে প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করেন তাতে উল্লেখ করা হয়, ওই দপ্তরের (বিএডিসি) জড়িত চক্রটি নানা জাতের ধানের বীজসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলে কৃষি ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনারও সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। অপরদিকে পূবালী ব্যাংক নরসিংদী শাখায় বড় ধরনের চেক জালিয়াতচক্র ধরা পড়েছে দুদকের ফরেনসিক টিমের কাছে। পরিচয় গোপন করে ওই চক্রটি কয়েক কোটি টাকা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল। প্রযুক্তির সহযোগিতায় তাদের নাম, পরিচয় ও ঠিকানা উদ্ধার করা হয়েছে।

দুদকের জারি করা পরিপত্রে দেখা যায়, ফরেনসিক ল্যাবের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের ডেটাবেজ তৈরির পাশাপাশি চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধান এবং এ সংক্রান্ত ডিজিটাল আলামত সংগ্রহ করে তা বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করে ফরেনসিক টিম কমিশনে উপস্থাপন করে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহজনক ব্যক্তির পাশাপাশি তাদের দুর্নীতি ও জালিয়াতির সব ধরনের ডকুমেন্ট সংগ্রহে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে দুদক।

সূত্র জানায়, দুদক নতুন করে দুর্নীতিবাজদের যে ডেটাবেজের কাজে হাত দিয়েছে তাতে চলমান অনুসন্ধানে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে, তাদের পর্যায়ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়া নতুন আসা অনেক নাম এই তালকায় যুক্ত হচ্ছে। গুরুতর অপরাধ ও দুর্নীতি বের করতে এরই মধ্যে কমিশনের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করা হয়েছে। ওই টিমের সদস্যরা বিশেষ বিশেষ কিছু ব্যক্তি এবং দুর্নীতির ঘটনা অনুসরণ করছে বলে জানা যায়।

বিদ্যুৎ খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপ, চট্টগ্রামের ম্যাক গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, নোমান গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, এননটেক্স, সাদ মুসা গ্রুপসহ প্রায় ২০টি শিল্প ও ব্যবসায়ী গ্রুপ; ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান; ৭টি ব্যাংক ও ৫টি বিমা সংস্থার বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। রয়েছে অন্তত ৪০ জন পৌর মেয়রের নাম। এর মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন-রাজশাহী বাঘা পৌর মেয়র আক্কাস আলী, পাবনার বেড়া পৌর মেয়র আবদুল বাতেন, পাবনার সাথিয়া পৌর মেয়র মিরাজুল ইসলাম, সুনামগঞ্জের তাহেরপুর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ, যশোরের কেশবপুর পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম, নড়াইল পৌর মেয়র আনজুমান আরা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান এবং রাজশাহীর পুঠিয়া পৌর মেয়র আল মামুন। এছাড়াও রয়েছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সদ্যবিদায়ি প্রধান প্রকৌশলী সাইদুর রহমান, দুদকের একজন উপপরিচালক, ৯ জন সংসদ-সদস্য, একজন প্রতিমন্ত্রী, বাংলাদেশ রেলের উচ্চপদস্থ তিন কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা, রাজউকের ২৭ জন কর্মকর্তা, বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের একসময়ের ক্যাশিয়ার ও ব্যবসায়ী এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক পরিচালক। এর বাইরেও বির্ভিন্ন শ্রেণি ও পেশার দুই শতাধিক ব্যক্তির নাম রয়েছে তালিকায়।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাট, দুর্নীতি দখলবাজি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী নেতা, আমলা, পুর্লিশ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজটি শিগগিরই শেষ করে অভিযান পরিচালনা করতে চায় দুদক।