‘হোমগ্রোন’ ফর্মুলা চায় যুক্তরাষ্ট্র

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের নিজস্ব রূপরেখা চায় যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন কোনো ফর্মুলা চাপিয়ে দেবে না।

বাংলাদেশের পরিস্থিতির বিষয়ে শলাপরামর্শ করতে পিটার হাস শিগগিরই ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। এর আগে তিনি সরকার ও রাজনৈতিক মহলে সিরিজ বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। ভিসানীতি মোতাবেক কেউ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে তাকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে ভিসানীতি অবহিত করে যুক্তরাষ্ট্র। ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেন ভিসানীতি ঘোষণা করেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। পিটার হাস এ বিষয়ে ২৫ মে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস শিগগিরই ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এটা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের রুটিন সফর। প্রতি বছরেই এই সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্বাগতিক দেশের পরিস্থিতি নিজ দেশে অবহিত করেন। তবে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবং ভিসানীতি ঘোষণার পর পিটার হাসের এবারের ওয়াশিংটন সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনীর বিষয়ে অগ্রগতি জানতে ২৯ মে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ চার রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা কমানোর কারণ জানতে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে। এছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে ভিসানীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তফাজ্জল হোসেন মিয়া, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন।

এসব বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। দলগুলো তাদের অবস্থান জানানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ওয়াশিংটনের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বারবারই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি জোর দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, বাংলাদেশ এমন নির্বাচন করুক, যা গোটা বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে। মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফর করেছেন। ওই সময়ে তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বিষয় ব্যক্ত করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। এসব বিষয়কে বাংলাদেশের জনগণের বিষয় বলে মনে করে দেশটি। এ কারণে এসব প্রসঙ্গে কোনো মার্কিন কর্মকর্তাই কোনো মন্তব্য করেননি। ভিসানীতির বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেছেন, তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন ভিসানীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই পথে হাঁটবে না। জুলাইয়ে ইইউ থেকে প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল আসবে। বাংলাদেশে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে নিশ্চিত হলে তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে। জাপানের রাষ্ট্রদূতও বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে বিএনপি, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেছেন। নির্বাচন কমিশন জাপানকে পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতও বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। জানতে চাইলে ভারতের থিংকট্যাংক গেটওয়ে হাউজের সিনিয়র ফেলো অমিত ভান্ডারি যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। এ বিষয়ে ভারতের কোনো বক্তব্য নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে সে প্রসঙ্গে আমি বলব, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তান ও মিয়ানমারের দিকে নজর দেওয়া।’ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতিমাত্রায় আগ্রহের নেপথ্যে ভূ-রাজনীতি এবং কৌশলগত স্বার্থ জড়িত রয়েছে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ যাতে চীনের প্রতি অধিকমাত্রায় ঝুঁকে না পড়ে সে লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টির কৌশল বলেও অনেকে মনে করেন। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপি উভয় দলই মার্কিন ভিসানীতিতে নিজেদের আত্মতুষ্টির দিকগুলো তুলে ধরছে। যদিও অভিজ্ঞ মহলের মতে, মার্কিন ভিসানীতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর।

সর্বশেষ মঙ্গলবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে তার গুলশানের কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আইন ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, আইএলও’র ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আইএলও’র ব্যাপারে কিছু একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সেটার ব্যাপারে, লেবার রাইটসের ব্যাপারে, উনাদের দল আসছিল, সেটা কনসাইজ করে একটা প্রস্তাব দিলেন। আমরা সেটা বোঝার জন্য মিটিং করলাম।’

রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আইএলও’র বাইরে আর কোনো বিষয়ে কোনো কথা হয়নি।’

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ সম্পর্কে সরকারের চিন্তা কি জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আইএলও নিয়ে কথা হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমার কথা বলার কথা নয়। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলার কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনার কথা চিফ ইলেকশন কমিশনারকে জিজ্ঞাসা করেন। উনি নির্বাচন করবেন। আমাদের প্ল্যান থাকবে কি! উনি নির্বাচন ডাকবেন, আমরা নির্বাচন করব। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।’

একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকে বিএনপি’র সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং নির্বাচন নিয়ে দলটির অবস্থান জানতে চেয়েছেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। মির্জা ফখরুল বিএনপির অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার দাবি জানিয়ে আসছে।

নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে সংবিধানের বাইরে যেতে চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে বর্তমান মন্ত্রীরা পদত্যাগ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। এটিই হবে নির্বাচনকালীন সরকার। নির্বাচনকালীন সরকারে জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোর প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে চায় সরকার। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু মঙ্গলবার বলেছেন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধির সামনে বসে বিএনপি’র সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী আওয়ামী লীগ।

জানতে চাইলে আমির হোসেন আমু যুগান্তরকে বলেন, ‘২০১৩ সালে জাতিসংঘের প্রতিনিধি তারানকো বাংলাদেশে এসেছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারানকো আমাদের আলোচনার যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। জ্বালাও-পোড়াও করে। এবারও জাতিসংঘ প্রতিনিধি এলে আমরা তাদের সামনে আলোচনা করতে রাজি আছি।’

তবে আমির হোসেন আমুর এমন মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে অস্বীকার করেছে বিএনপি। জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘কে কোথায় কোন মিটিংয়ে কি বক্তৃতা দিয়েছে, তার কোনো প্রতিক্রিয় দিতে পারি না।’

এদিকে, বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড়। খালেদা জিয়ার পরিবারের কোনো সদস্য ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চিন্তা করছেন না। ফলে আলোচনার প্রাথমিক শর্ত হতে পারে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নামে করা ৩৫ লাখ রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার।