পটুয়াখালী জেলা প্রতিনিধিঃ
নাদিয়ারা তিন বোন। তিনজনের বড় নাদিয়া। তার স্বপ্ন ছিল বড় ফার্মাসিস্ট হওয়া। আর এ স্বপ্ন শুধু নাদিয়ার একার নয়, ছিল পুরো পরিবারের; কিন্তু সেই স্বপ্ন পিষ্ট হলো সড়কে। নাদিয়ার দাফনের সঙ্গে মাটিচাপা পড়ে গেল পুরো পরিবারের প্রত্যাশা, যা আর কোনো দিনই মাথা তুলে দাঁড়াবে না।
রোববার রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহণের একটি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় নিহত হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাদিয়া আক্তার। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে। প্রায় ২০ বছর ধরে তার পরিবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকায় বসবাস করেন।
ঢাকা থেকে সোমবার সকালে রাঙ্গাবালী সদর ইউনিয়নের পূর্বনেতা গ্রামের নিজ বাড়ি পৌঁছায় নাদিয়ার মৃতদেহ। সকাল সাড়ে ১০টায় ওই গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সম্পন্ন হয় দাফন।
এদিকে তার মৃত্যুশোকে বিহ্বল পুরো পরিবার, সঙ্গে বুক ভারি হয়ে এসেছে পাড়া-প্রতিবেশীদেরও।
নাদিয়ার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মা পারভীন আক্তারের আহাজারি যেন থামছেই না। ক্ষণে ক্ষণে মেয়ের কবরের দিকে ছুটে যান তিনি। কিছুক্ষণ পরপরই হয়ে পড়েন অজ্ঞান। বিলাপ আর আহাজারিতে বলছেন- ‘ও মাগো তুমি মাটির কবরে কেমনে থাকবা আমাগোরে ছাড়া? গতকালও আমার কাছে ফোনে বললো মা আমার আজ ক্লাস নাই, বই কিনতে যাব। এ কেমন বই কিনতে গেলা মা?।’
মেয়ের শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন বাবা জাহাঙ্গীর মৃধাও। বাড়ি উঠোনে চেয়ারে বসে কখনো চোখের পানি মুছছেন, আবার কখনো মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকছেন। বুকভরা কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল নাদিয়া। আমার কোনো ছেলে নাই। মেয়েরাই আমার সব।
আক্ষেপ করে বলেন, মানুষ তো চিরকাল বাঁচে না। ভাবছিলাম মেয়েটা স্ট্যাবলিস্ট (প্রতিষ্ঠিত) হবে। ছোট দুই বোনের দেখাশুনা ও (নাদিয়া) করবে- এমন আশা ছিল আমাদের; কিন্তু আমার সব স্বপ্ন শেষ।
চোখের কোণে জমে থাকা ছলছল লোনা জলে নাতনির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দাদা ধলু মৃধা বলেন, অত্যন্ত ভালো মেয়ে ছিল। কলেজে পড়তো ঠিকি মাথায় হিজাব পরে ক্লাস করত। সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করত। আমি মাঝে-মধ্যে ঢাকা গেলে আমাকে গ্রামে আসতে দিতে চাইত না। বলত দাদা তুমি এখানেই থেকে যাও। গ্রামের বাড়িতে দাদি বুড়ো মানুষ তোমার ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারে না। আবার গ্রামে এলে প্রায়ই ফোন করে বলত দাদা তুমি ঢাকায় চলে এসো। আমাদের সঙ্গে থাকো দাদাভাই, ঢাকায় সবাই আছে শুধু তুমিই নাই।
নিহত নাদিয়ার পরিবারের তথ্যানুযায়ী, নাদিয়ার ফার্মাসিস্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণের যাত্রা মাত্রই শুরু হয়েছিল। দুই সপ্তাহ আগে রাজধানীর নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্লাস করতে এক সপ্তাহ আগে নারায়ণগঞ্জের বাসা ছেড়ে উত্তরার একটি মেসে উঠেন। কিন্তু এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার সেই স্বপ্নযাত্রার ইতি ঘটল।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়েছিল নাদিয়ার। কিন্তু দূরের কলেজ, তাই ভর্তি করেনি পরিবার। পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্দানের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি করানো হয়। আসা যাওয়া সহজ করতে গত সপ্তাহে উত্তরার আশকোনা এলাকার একটি ছাত্রী নিবাসে উঠেন নাদিয়া।
নাদিয়ার মামা বেল্লাল হোসাইন বলেন, ভাগ্নিকে নিয়ে বোন এবং দুলাভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। ভাগ্নি পড়ালেখা করে চাকরি করবে। বোন সামিয়া ও মারিয়ার দায়িত্ব নেবে। বাবা-মায়ের অবর্তমানে সেই হবে ওই দুই বোনের অভিভাবক; কিন্তু এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিমিষেই শেষ হয়ে গেল সব।
উল্লেখ্য, রোববার ক্লাস না থাকায় এক বন্ধুর সঙ্গে তার মোটরসাইকেলে করে বই কিনতে বাসা থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যাচ্ছিলেন নাদিয়া। কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় তাদের মোটরসাইকেলটি ধাক্কা দেয় ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের একটি বাস। এতে রাস্তায় ছিটকে পড়েন নাদিয়া। পরে বাসটি তাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।
ওই রাতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাদিয়ার ময়নাতদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ছোট মসজিদের মাঠে জানাজা সম্পন্ন হয়। পরে সোমবার সকালে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়।