কালের সাক্ষী বালিয়াটি জমিদার বাড়ি

মোঃ সাইফুল ইসলাম ,ধামরাই ;

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি উনিশ শতকের স্থাপত্য কৌশলের একটি অন্যতম নিদর্শন। প্রায় দুশ’ বছরের পুরাতন জমিদার বাড়িটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ বাড়িটি থেকে তৎকালীন সময়ের মানুষের জীবন-জীবিকা, চাল-চলন, আনন্দ-বিনোদন আর শৌখিনতার পরিচয় পাওয়া যায়।
ইতিহাসের বিরল সাক্ষী হয়ে এখনো সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে মানিকগঞ্জের বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়িটি তৎকালীন জমিদারদের আভিজাত্যেরই বহি:প্রকাশ। কারুকার্যখচিত মনোমুগ্ধকর প্রতিটি ভবনের দেয়াল দেখলেই বোঝা যায় যে, তারা কতটুকু সৌন্দর্য প্রিয় ও রুচিশীল ছিলেন।মোট সাতটি স্থাপনা নিয়ে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি অবস্থিত। জানা যায় এই প্রশাধের অন্তর্গত বিভিন্ন ভবন জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উওরাধিকার কতৃক বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত হয়েছিল। যা উনিশ শতকে নির্মিত ২০ একরের চেয়ে বেশি স্থান জুড়ে অবস্থিত। স্থাপত্য কৌশলে অন্যতম এক নির্দশন। এর সুউচ্চ ভবন, দৃষ্টি নন্দন বিশাল দিঘি, ধ্বংসাবশেষ পুকুর ঘাটলা আজো সৌন্দর্যের আভাস ফুটিয়ে তোলে
জমিদার বাড়ির প্রবেশ মুখে রয়েছে বিশাল দুটি সিংহদ্বার, যা পেরোলেই খোলা চত্বর। তারপরই রয়েছে জমিদার বাড়ির মূল ভবন। জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায় রয়েছে চারটি বিশাল ভবন, বন্দীশালা, গোলাঘর, রংমহল, দরবার হল, অন্দর মহল ।বাড়ির সামনে দু’ঘাটলা বিশিষ্ট বিশাল পুকুর। সদর ঘাটলায় জমিদার বাহাদুর আর বিপরীত ঘাটলায় তার কর্মচারীরা ব্যবহার করতেন। একই ব্যবস্থা ৩ ঘাট বিশিষ্ট ভেতর বাড়ির পুকুরের বেলায়। সদর ঘাটলায় জমিদার রাণী আর উল্টো ঘাটে মহিলা কর্মচারীরা স্নান সারতেন। বাড়ির ভেতরে পুকুরের উল্টোদিকে রয়েছে সারিবদ্ধ প্রায় ৩০টি টয়লেট। এগুলো দেখলেই বুঝা যায় বর্তমান সময়ের কোন আবাসিক ভবন নির্মাণের চেয়েও ব্যয়বহুল। সে আমলে কত টাকা ব্যয়ে এ প্রাসাদ নির্মাণ হয়েছে তা ধারণা করে বলা মুসকিল। প্রাসাদ তৈরি করেই ক্ষান্ত ছিলেন না জমিদাররা। এ প্রাসাদের পাশেই জমিদার বাবুর ভাগ্নে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামে “ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা তাদের আর এক নিদর্শন। এখানেই শেষ নয় রাজধানী ঢাকাতে “জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয়” আর হল নির্মাণ করেছিল জমিদার পিতা জগন্নাথের নামে।
এ জমিদার বাড়িতে ১৯৮৪ সালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা বর্তমানে স্থানান্তরিত হয়ে জমিদারের বাগান বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে।
জানা যায়, মানিকগঞ্জের শিবালয় থানাধীন বিনোদপুর ছিল বালিয়াটি জমিদারদের পূর্ব নিবাস। মহেশরাম সাহা নামে ছোট্ট এক কিশোর নিতান্তই ভাগ্যের অন্বেষণে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি আসেন এবং জনৈক পানের ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকরি নেয়। পরবর্তীতে ওই বাড়ির মেয়ে বিয়ে করে শশুরের সঙ্গে ব্যবসা করে প্রথম শ্রেণীর ব্যবসায়ী হন। মহেশ রামের ছেলে ঘনেশ রাম লবণের ব্যবসা করে আরও উন্নতি লাভ করেন। ঘনেশরামের ঘরে গোবিন্দরামসহ চার ছেলে জন্ম গ্রহণ করে। গোবিন্দরাম বালিয়াটিতে বিয়ে করে এখানেই বসবাস শুরু করেন। গোবিন্দরামের চার ছেলে যথাক্রমে আনন্দরাম, দধিরাম, পন্ডিতরাম ও গোপালরাম। এই চার ভাই প্রথমে একসাথে এবং পরে পৃথক পৃথক ভাবে ব্যবসা শুরু করেন। উক্ত চার ভাই থেকেই বালিয়াটি গোলাবাড়ি, পূর্ব বাড়ি, পশ্চিমবাড়ি, মধ্যবাড়ি ও উত্তর বাড়ি নামে ৫টি জমিদার বাড়ির সৃষ্টি হয়।
আনুমানিক ১৭৯০ সালে চার ভাইয়ের মাধ্যমেই জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন হয়। জানা গেছে, ১৯৪৮ সালে সপরিবারে ভারত চলে যান জমিদার। এরপরেই পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করে নেয়। পরে ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে নতুন করে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয় ।
জমিদার বাবুরা বেশির ভাগ সময়ই রংমহলে কাটাতেন। রংমহলে তারা সুর, সরাব আর নর্তকীদের নৃত্যের ঝংকারে মগ্ন থাকতেন। বর্তমানে রংমহলের কক্ষটিতে শোভা পাচ্ছে জমিদারের ব্যবহার্য বিভিন্ন আসবাব পত্র। রংমহলে রাখা কাচের আয়না ও শ্বেত পাথরে দুটি গাভী খুব সহজেই সকলের দৃষ্টি কাড়ে।
কথা হয় স্থানীয় ৮০ বছরের বৃদ্ধ আনছার মিয়ার সাথে। তিনি জানান জমিদারদের আচরণের কথা। তাদের আমলে জুতা পায়ে আর ছাতা মাথায় নিয়ে যে কেউ এ বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে পারতো না। এতে নাকী বাবুদের অসম্মান হতো। এ নিয়ম অমান্য করলে তাকে প্রচন্ড শাস্তি পেতে হতো।
দেশের খ্যাতিমান পরিচালকদের চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিফিল্ম, প্রামান্ন চিত্র নির্মাণের শুটিং করতে প্রায়ই দেখা যায় এ বাড়িতে। বাদ যায়নি জনপ্রিয় নির্মাতা হানিফ সংকেত এর ইত্যাদিও। ইতিহাসের নিদর্শন হিসেবে ২০১১ সালে পরিচালক হানিফ সংকেত “ইত্যাদি”র সবটুকু চিত্রায়নই এ প্রাসাদের সামনে করেন। তার শুটিংয়ের আলোক সজ্জায় প্রাণ ফিরে পেয়েছিল নিঃসঙ্গ প্রাসাদটি। যেন জমিদার বাহাদুর আবার প্রাসাদে ফিরে এসেছেন! কালজয়ী ছবি বেহুলা লক্ষিন্দর, জীবন সিমান্তেসহ অসংখ্য চলচিত্রের শুটিং হয়েছে এ বাড়িতে। শুটিং করতে ঢাকার আগারগাঁও প্রত্নতত্ব বিভাগের অফিসে অনুমতি নেন পরিচালকরা। এতে সরকারের প্রচুর রাজস্ব আয় হয়।