আলোকিত স্বদেশ,কুমিল্লা প্রতিনিধি:
তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের মহিয়সী নারী, দেশের গৌরব, ১৪ পরগনার জমিদার, প্রথম নারী নবাব, ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর কুমিল্লা লাকসাম জমিদার বাড়ীতে শনিবার বিকালে আকষ্মিক পরিদর্শণে আসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত, আর্ল আর মিলার।
রাষ্ট্রদূত কুমিল্লার নারী নবাব লাকসামের জমিদার বাড়ীতে ফয়জুন্নেছা ভিলাসহ বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাবলী পরিদর্শন শেষে ওই জমিদার বাড়ীর মাঠে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সুধীজনদের সাথে মতবিনিময় কালে নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ বাবুল চন্দ্র শীল ও লাকসাম সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ডাঃ জামিয়া বিনতে আলম রাষ্ট্রদূতের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং এ উপমহাদেশের প্রথম নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর নানাহ স্থাপনা, বিশ্ব ব্যাপী অবদানসহ নানাহ দিক তুলে ধরেন। এ জমিদার বাড়ীর উন্নয়নে আর্থিক বিষয়ে সহয়তা করতে তাৎক্ষনিক উপস্থিত মার্কিন দূতাবাসের সিনিয়র কর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করেন।
এ সময় লাকসাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এড. ইউনুছ ভূঁইয়া, পৌরসভা মেয়র অধ্যাপক আবুল খায়ের, উপজেলা নির্বাহী অফিসার একেএম সাইফুল আলম, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উন্নয়ন সমন্বয়কারী মহব্বত আলী, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরীর বংশধর ও ষ্ট্যাট মোতয়াল্লী নবাবজাদা সৈয়দ মাসুদুল হক চৌধুরী ও মার্কিন নাগরিক এবং জমিদার বংশধর মোহাম্মদ ফজলে রহমান চৌধুরী ( আয়াজ), মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ প্রত্ন তত্ত¡ অধিদপ্তর কুমিল্লার কর্মকর্তাবৃন্দ, জেলা- উপজেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সার্বজনীন লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার তৎকালীন হোমনাবাদ পরগনা লাকসামের এককালের খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেষে পশ্চিমগাঁও গ্রামে নবাব ফয়জুন্নেছা জন্ম গ্রহণ করেন। তৎকালীন হোমনাবাদের জমিদার আহম্মদ আলী চৌধুরী ও ভুলুয়ার জমিদার আসাদ চৌধুরী কন্যা আরফান্নেছা চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ কন্যা হলেন এ মহিয়সী নারী ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। নবাব ফয়জুন্নেছার দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে সৈয়দা বদরুন্নেছা চৌধুরানীকে নিজ গ্রাম পশ্চিমগাঁওয়ে এবং অপর মেয়ে সৈয়দা আসাদুন্নেছা চৌরানীকে বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার জমিদার বাড়ীতে বিয়ে দেয়। বাল্য কালে ফয়জুন্নেছার ওস্তাদ তাকে শুধূ আরবী-উর্দু ও ফারসিই পড়াননি একই সাথে বাংলা ও সংস্কৃত চর্চাও শিখিয়েছেন। পরিবার-পরিজন ও এলাকার লোকজন তাঁকে ফয়জুন বেগম বলে ডাকতেন।
ওই জমিদার বাড়ীর একাধিক সূত্র জানায়, জমিদার ফয়জুন্নেছার সারাজীবন ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলার মধ্যে। জমিদারী পরিচালনা ছাড়াও তাঁর দুটি প্রধান সাধনা ছিল আল্লাহর ইবাদত এবং সাহিত্য সাধনা। নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর জমিদারীর ১৪টি মৌজা ছাড়াও দেশে-বিদেশে ১৪টি প্রাথমিক মক্তব, প্রাথমিক বিদ্যালয়, দ্বীনিয়াত শিক্ষা, হাইস্কুল, বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল, দিঘী-পুকুর, মসজিদ, মুসাফিরখানা, পুল-ব্রিজ, পত্র-পত্রিকায় পৃষ্ঠপোষকতা, কবি সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ, ফয়জুন পাঠাগার, রূপজালাল গ্রন্থ রচনাসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করে গেছেন তিনি। এছাড়া ১৮৯৪-৯৫ সালে মক্কাশরিফে হজ্বব্রত পালন করতে গিয়ে ওই দেশের বাদশা আব্বাসিয় খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী নামে যোবায়দা নহর পুনঃখনন এবং একটি মুসাফিরখানা রোবাত স্থাপন করেন।
১৮৯১ সালের ১৮ জুন তার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি জনকল্যানে ওয়াকফ করে দেন। তিনি তাঁর ১৪ পরগনায় প্রায় সময়ই পালকীতে চড়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড তদারকিতে যেতেন। ১৯৯৬ সালে একুশে পদক ছাড়াও মিলেছে তার ভাগ্যে বিভিন্ন নারী বিষয়ক খেতাব। অথচ বেগম রোকেয়ার জন্মের ৭ বছর পূর্ব থেকেই এ নারী জমিদার ফয়জুন্নেছা দেশে-বিদেশে বহু জনকল্যান মূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। তার জমিদারীর শাসনামলে হাসি কান্না দুঃখ বেদনায় ভরপুর তার সার্বিক জীবনে কাহিনী নিয়ে রূপক কাব্যগ্রন্থ রূপজালাল বইটি ১৮৭৬ খ্রিঃ প্রকাশ করা ছাড়াও তার কর্মজীবনের উপর বিভিন্ন লেখক ও গবেষক প্রায় ২০টির মত বই রচনা করেছেন। অবশেষে ১৯০৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর এ মহিয়সী প্রথম রানী নবাব ফয়জুন্নেছা চির নিদ্রায় শায়িত হন তারই নির্মিত নবাব বাড়ি জামে মসজিদের পাশে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে।