ধামরাইয়ে হারাতে বসেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

ধামরাই প্রতিনিধি:

প্রাচীন সভ্যতার অপূর্ব উপকরণ মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তি পথে। পুরুষ ও বউদিদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে ওঠে বিভিন্ন ধরণের সৌখিন সামগ্রী । তাদের বলা হয় পাল সম্প্রদায় এ শিল্পের প্রাণপুরুষ পালদের বর্তমানে চলছে চরম দুর্দিন।

মৃৎশিল্প মানুষের উদ্ভাবিত প্রারম্ভিক শিল্পকলার একটি। বাংলাদেশের লোকজ কারুকাজে মৃৎশিল্পের কারিগরিদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।মাটি দিয়ে তৈরি নানা রকম বাহারী নজরকাড়া তৈজয়পত্র আমাদের নান্দনিক জীবন ও সাংস্কৃতিকে করেছে আরো বিকশিত। অবহমান বাংলার লোক শিল্পের বিকাশ ঘটে প্রধানত মৃৎশিল্পের তৈরি পন্যের মাধ্যমে। অনুমানিক প্রায় দশহাজার বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম মৃৎশিল্পের অর্বিভাব ঘটে। এরপর প্রথমে মিশরে কুমারের চাকা আবিস্কারের কথা জানা গেলেও কুম্ভকারের আদিনিবাস পৃথিবীর কোন আঞ্চলে ছিল কিনা তা এখনো জানা যায়নি। তবে অনুমানিক ১৫০০খ্রিস্টপুর্ব থেকে বাংলাদেশে এক বিশেষ শিল্প হিসাবে বিকাশ লাভ করে।কিন্তু আজ সেই মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে।

এরপর মৃৎশিল্পের জন্য যে কাদা মাটি ব্যবহার করা হয় তা একটু আলাদা ধরনের। যেমন নদীর অববাহিকাতেই এই মাটি বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই মাটি পাওয়া যায়। এই মাটি দিয়ে তৈরি হত আমাদের নান্দনিক জীবনের প্রয়োজনীয় সকল কাজের পাত্র হিসাবে। কিন্তু আজ আর সেই কাজের জন্য মাটির পাত্রের প্রয়োজন হয় না। যার কারণে মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিঃমিঃ দুরে উত্তর পশ্চিম দিকে ধামরাই উপজেলার অবস্থান। এই ধামরাই উপজেলায় এক সময় ছিল মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত। কারণ বংশী নদীর কোল ঘেষে পাল সম্প্রাদায়ের বসবাস। সেখানে মৃৎশিল্প তৈরি করতে সুবিধা ছিল। কারণ নৌকা দিয়ে মাটি আনতে ও পৌছাতে ছিল সুবিধা যার কারণে বেশির ভাগ পাল সম্প্রাদায়ের বসবাস হয় নদীর তীরে।আবার সেখান থেকে নদী পথে যাতায়াত বা মালামাল এদিক সেদিক নিতে ও ছিল অনেক সুবিধা। এই কারনে বেশির ভাগ পালদের নদীর পারে কাজ করতে দেখা যায় আর সেটা ছিল ধামরাই  পালপাড়া বংশী নদীর পারে।

গুকুল পাল  ও ধীরেন পালেরা পূর্বপুরুষ  থেকে এই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। তারা এক সময় এই ব্যবসা করে পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ সুখে দিন কাটাতেন। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকায়নের ফলে বাজারে টিকে থাকতে পারচ্ছে না। কারণ বর্তমানে বাজারে প্লাস্টিকের সওলাব হওয়ার কারনে মাটির তৈরি পণ্য আর কেউ ক্রয় করতে চাই না।আবার এই কাজের জন্য অনেক পুজি লাগে। কারণ বর্তমান বাজারের সব জিনিসের দাম উর্ধগতির জন্য অল্প টাকায় এই ব্যাবসা এখন আর হয় না। যার জন্য কাজের তুলনায় প্রয়োজনীয় পুজি স্বল্পতার কারণে এই পেশার নৈপুণ্যতা হারাতে বসেছে বলে জানান পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা।

ইতি মধ্যে অনেকেই জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পেশায় অংশ গ্রহন করেছে। ফলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহি এই মৃৎশিল্প। ধামরাই কাগজিপাড়া ওবেলীশ্বর  পালপাড়া এই বিশাল দুটি এলাকায় মৃৎশিল্পের কাজ হয় বেশি। কারণ এই এলাকায় প্রায় ১০০টি হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। এদের মধ্যে সন্তোষপাল ও গদাপাল  বলেন বর্তমানে আমরা  মৃৎশিল্পের  কাজ করে আমাদের সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমান বাজারের সাথে টিকে থাকতে আমাদের যা দরকার সেটা নেই আবার  আধুনিকায়ন হওয়ার কারনে আমরা বাজারে টিকে থাকা ও মুসকিল হয়ে পড়েছে। যার কারণে দার পাল সম্প্রদায়েরা মৃৎশিল্প বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এই জন্য মৃৎশিল্প আজ ধংশের দার প্রান্তে এসে দারিয়েছে বলে জানান তারা। এর মধ্যে অনেকই আছে যারা আন্য কোন  পেশায় কাজ করতে পারে না তারা আজ অনাহারে দিন যাপন করতেছে বলে জানান পাল সম্প্রদায়ের লোকেরা। এর মধ্যে কিছু আছে যারা ওয়াডারের মাধ্যমে কাজ এনে কাজ করে। যেমন ফুলের টপ,ফুলদানি, কিছু খেলনা, আর কিছু হাড়ি পাতিল তৈরি করে কোন রকমে দিন চলে তাদের। তা ও আবার বিভিন্ন ধরনের এনজি ও থেকে লোন এনে কড়া সুধে সুধ দিয়ে ফেরত দিতে হয়। এরই কারণে আজ মৃৎশিল্প বিলুপ্তির ধারপ্রান্তে এসে পৌছিয়েছে। তাই পাল সম্প্রদায়দের একটাই দাবি তারা যদি সরকারের কাছ থেকে যে কোন ধরনের সহযোগিতা পায় তাহলে তাদের এই ঐতিহ্যবাহি মৃৎশিল্পকে বাচিয়ে রাখা সম্ভব বলে দাবি তাদের।

এ ব্যাপারে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার এস. এম. হাসান, বলেন করোনাসহ যে কোনো দুর্যোগে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত এই প্রকল্পের মাধ্যমে ধামরাই উপজেলার প্রান্তিক পেশাজীবী মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে আসা, আদি পেশা টিকিয়ে রাখা ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।