প্রয়োজনীয় ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
২০০০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের এবং রোগীর ব্যয়ের একটি পরিসংখ্যান গত ১৫ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাজেট বরাদ্দ হয় বাংলাদেশে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের ১৭ কোটি ১২ লাখ মানুষের বিপরীতে টাকার অঙ্কে সরকার ব্যয় করবে গড়ে ৩ হাজার ৪২ টাকা (২৬ ডলার)। ২০০০ সালে বাংলাদেশে রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকার ব্যয় করত গড়ে ৮ ডলার। ২০২১ সালে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ৯ ডলার।
রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ভারের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। ৭৯ শতাংশ ব্যয়ের ভার নিয়ে যৌথভাবে শীর্ষে রয়েছে আর্মেনিয়া ও তুর্কিস্তান। এই সূচকে ৭৭ শতাংশ রোগীকে ব্যয় করতে হয় যৌথভাবে ইকুয়েটোরিয়াল গিনি এবং আফগানিস্তানে। নাইজেরিয়ার নাগরিকদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৬ শতাংশ নিজেকেই বহন করতে হয়। এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশে নাগরিকদের ব্যয় করতে হয় ৭৩ শতাংশ। প্রতিবেশী মিয়ানমারে রোগীর ঘাড়ে ৭০ শতাংশ ব্যয়ের বোঝা। টোগোতে ৬৯ শতাংশ, ক্যামেরুনে ৬৭ শতাংশ। এ তালিকায় সবচেয়ে কম ৬৬ শতাংশ বহন করতে হয় আজারবাইজানের নাগরিকদের।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের নাগরিকদের চেয়ে বাংলাদেশে একজন রোগীকে বেশি ব্যয় করতে হয়। মালদ্বীপের নাগরিকরা চিকিৎসা ব্যয়ের মাত্র ১৪ শতাংশ নিজেরা বহন করে। ভুটানের এই ব্যয়ের হার ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪৪ শতাংশ, ভারতে ৫০ শতাংশ, নেপালে ৫১ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ ব্যয় রোগীরা বহন করে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় রোগীর ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বাজেট বরাদ্দের স্বল্পতাকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ১৭ কোটি মানুষকে ভালো রাখতে বাজেটের অন্তত ১২ থেকে ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রয়োজন। সেখানে বরাদ্দ ৫ শতাংশে আটকে আছে। এ বছর প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ। মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য এই অর্থ অপর্যাপ্ত। এর পরও সমস্যা হলো, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের অর্থ চিকিৎসাসেবায় ব্যয় করা সম্ভব হয় না। সীমিত অর্থের বিরাট অংশ কাজে লাগাতে পারে না মন্ত্রণালয়। সেগুলো ফেরত যায়। এতে সরকারি সেবার পরিধি ছোট হচ্ছে। রোগীকে অর্থ খরচ করে বেসরকারিতে সেবা নিতে হচ্ছে। এজন্য দেশের জিডিপির বড় অংশ স্বাস্থ্যে বরাদ্দ দিতে হবে। সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ বিনামূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যেও এই বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের প্রমাণ মিলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। সবশেষ বাজেটে বাংলাদেশে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে মাত্র ২৬ ডলার। প্রতিবেশী মিয়ানমারে এই ব্যয়ের পরিমাণ ৪৮ ডলার। পাকিস্তানে ৪৯ ডলার, নেপালে ৭৬ ডলার, ভারতে ৮১ ডলার। শ্রীলঙ্কায় সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বেশ ভালো। সেখানে ব্যয় করা হয় গড়ে ২৮৩ ডলার। মালদ্বীপ তার নাগরিকদের জন্য বছরে ব্যয় করে প্রায় ১ হাজার ৪৭৯ ডলার। বৈশ্বিক সূচকেও স্বাস্থ্য ব্যয়ের হিসেবে তলানিতে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত ১১২টি দেশের স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম সরকারি ব্যয়ের ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম। এই তালিকায় আফগানিস্তান ছাড়া বাকি ১৮টি দেশ আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দরিদ্রতম দেশ।
কম ব্যয়ের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ সুদান। সেখানে সরকার গড়ে ব্যয় করে ৫ দশমিক ৪ ডলার। এরপর কঙ্গোতে ৭ দশমিক ৬ ডলার। মাদাগাস্কারে সরকার ব্যয় করে ১১ দশমিক ৯ ডলার, সেন্ট্রাল আফ্রিকায় ১১ দশমিক ৯ ডলার, বেনিনে ১২ ডলার, আফগানিস্তানে ১২ ডলার, টগোতে ১২ দশমিক ৯ ডলার, হাইতিতে ১৩ দশমিক ৪ ডলার, শাদে ১৪ দশমিক ১ ডলার, ইরত্রিয়ায় ১৬ দশমিক ৯ ডলার, লাইবেরিয়ায় ব্যয় ১৭ ডলার, বুরুন্ডিতে ১৭ দশমিক ৩ ডলার, ক্যামেরুনে ১৯ দশমিক ৭ ডলার, গিনিতে ২০ ডলার, জিম্বাবুয়েতে ২০ দশমিক ৭ ডলার, মালাউইয়ে ২১ দশমিক ৯ ডলার, গিনি বিসাউয়ে ২৪ দশমিক ১ ডলার, ইথিওপিয়ায় ২৪ দশমিক ৯ ডলার, বাংলাদেশে ২৫ দশমিক ৯ ডলার এবং সবশেষ তানজানিয়ায় জনপ্রতি সরকার ব্যয় করে ২৬ দশমিক ১ ডলার।
জিডিপির হিসাবেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমেছে: দেশের উন্নয়নের প্রধান সূচক হলো জিডিপি। মোট দেশজ উন্নয়নের মাত্র দশমিক ৪০ শতাংশ অর্থ সরকার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে। ২০০০ সালে এই ব্যয়ের পরিমাণ ছিল দশমিক ৫১ শতাংশ। ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির হিসাবে বরাদ্দের পরিমাণ নিম্নগামী। বাংলাদেশের তুলনায় ভুটান প্রায় পাঁচগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে। শ্রীলঙ্কায়ও প্রায় চারগুণের বেশি অর্থ ব্যয় করে। মিয়ানমার, নেপাল স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হিসেবে প্রতিনিয়ত উন্নতি করছে। পাকিস্তান ছাড়া এ তালিকায় সবাই উন্নতি করেছে।
জিডিপির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে কম স্বাস্থ্য ব্যয়ের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এই সূচকে শীর্ষে রয়েছে বেনিন। সেখানে দশমিক ৩২ শতাংশ ব্যয় করা হয়। এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশে এখন দশমিক ৪০ শতাংশ ব্যয় করা হয়। সূচকে দশমিক ৪৩ শতাংশ ব্যয়ের হিসাবে বাংলাদেশের পর হাইতির অবস্থান। ক্যামেরুন ব্যয় করে দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ ছাড়া নাইজেরিয়া দশমিক ৫৪ শতাংশ, টেগো দশমিক ৫৫ শতাংশ, কঙ্গোতে দশমিক ৬৩ শতাংশ, ইকুয়েডর দশমিক ৬৮ শতাংশ, গিনি দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং লাওসে দশমিক ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়।
জিডিপির হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে কিউবা। সেখানে ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ ব্যয় করা হয় স্বাস্থ্য খাতে। এরপর নাউরু ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, কিরিবাতি ১১ দশমিক ১২ শতাংশ, ব্রিটেন ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, জার্মানি ১০ দশমিক ২২ শতাংশ, টুভালু ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ, সুইডেন ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ফ্রান্স ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন ফোরামের কনভেনার ডা. সৈয়দ রুবায়েত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ একজন মানুষের পেছনে গড়ে ২৬ ডলার ব্যয় করেছে। এ সময়ে প্রতিবেশী মিয়ানমার ৪৮ ডলার ব্যয় করেছে। পাকিস্তান নানা সংকটের মধ্যেও ৪৯ ডলার ব্যয় করেছে। নেপালে ৭৬ ডলার, ভারতে ৮১ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ২৮৩ ডলার জনপ্রতি ব্যয় করেছে। সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে মালদ্বীপ। তারা ওই বছর জনপ্রতি গড়ে ১ হাজার ৪৭৯ ডলার ব্যয় করেছে।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হয়। ২০০০ সালে মোট ব্যয়ের ৬২ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হতো। এরপর প্রতিনিয়ত শুধু বাড়ছেই সূচক। রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ৮ দশমিক ৬১ মিলিয়ন বা ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০৩২ সালের মধ্যে রোগীর ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। ফলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে যাবে। তাই স্বাস্থ্যে বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে। রোগীদের ঘাড় থেকে চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমাতে হবে।