যেসব কারণে ঢাকাকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে নতুন সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তাসহ বিস্তৃত ক্ষেত্রে সহযোগিতার জাল বিস্তার করতে চায় ওয়াশিংটন।

কার্যত প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে পাশে দেখতে চায় বাইডেন প্রশাসন। মার্কিন প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরের পর এই আভাস দিয়েছে ওয়াকিবহাল কূটনৈতিক সূত্র।

সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ‘দ্য ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন’ (ডিএফসি) থেকে বাংলাদেশকে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি দল।

এছাড়াও, নিরাপত্তা ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত ‘অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’ (আকসা) এবং ‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ (জিসোমিয়া) সই করার প্রক্রিয়া জোরদারেরও তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো ইস্যুতেও বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী এবং দেশটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক আইলিন লবাখার, মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি’র এশিয়া ব্যুরোর সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিপার এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তারের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি গত ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেছে।

নতুন এক প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফর অনুষ্ঠিত হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কেননা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খুবই সোচ্চার ছিল। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরপরই দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বলে মন্তব্য করা হয়। চীন, ভারত, জাপান, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানালেও যুক্তরাষ্ট্র অভিনন্দন জানায়নি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। চিঠিতে বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর কোনো প্রসঙ্গ উল্লেখ ছিল না। তবে চিঠিতে বাইডেন সরাসরি সই করেননি; বরং যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রেসিডেন্টের রেফারেন্স দিয়ে চিঠিটি পাঠিয়েছে। কূটনীতিকরা বলছেন, যদিও সই ছাড়াই সরকারের তরফে রেফারেন্স দিয়ে চিঠি পাঠানোর রেওয়াজ কূটনীতিতে রয়েছে; কিন্তু সই থাকলে বিষয়টি আরও জোরালো হতো বলে কারও কারও অভিমত।

সূত্র মতে, ভোটের আগে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের যে অস্বস্তিকর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছিল তার জন্য বাংলাদেশে সরকারি মহল ঢাকায় মার্কিন কূটনৈতিক মিশনকে দায়ী করে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় যাওয়াসহ বিভিন্ন তৎপরতা ক্ষেত্র বিশেষে ভুল বার্তা দিয়েছিল বলে সরকারি সূত্রগুলো জানায়। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছে বলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়। মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরকালে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ছুটিতে সিঙ্গাপুর যাওয়া বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ। ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক উন্নয়নের এই ধারায় আগামী কিছু দিনের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন। তারপর সম্পর্ক জোরদারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মার্কিন প্রতিনিধি দলের সফরের ফলাফল সম্পর্কে অভিমত জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে তারা নতুন করে সম্পর্ক শুরু করতে চায়। আমরাও আগ্রহ ব্যক্ত করেছি। যুক্তরাষ্ট্র বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে কাজ করতে আগ্রহী। এখন আমরা কীভাবে এটাকে কাজে লাগাব এটা আমাদের সক্ষমতা, দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সাধারণ একটা জায়গায় স্থির হয়ে থাকি। বাস্তবে একটি বড় ল্যান্ডস্কেপে কাজ করলে বহুক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক লাভজনকভাবে কাজ করা যায়।’

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ডিএফসি থেকে অর্থ সহায়তার প্রস্তাবকে ঢাকার সঙ্গে নতুন ধরনের সম্পর্ক সৃষ্টির সূচনা বলে অনেকে মনে করেন। ডিএফসি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী সংস্থা। এটি নিু ও মধ্য আয়ের দেশে বেসরকারি খাতে অর্থায়ন করে থাকে। সংস্থাটি ঋণ, ইকুয়িটি ইনভেস্টমেন্ট, সম্ভাব্যতা যাচাই, বিনিয়োগের তহবিল, রাজনৈতিক ঝুঁকির বীমা, কারিগরি সহায়তা খাতে অর্থায়ন করে থাকে।

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশের তরফে মার্কিন প্রশাসনের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়। বৈঠককালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মার্কিন প্রতিনিধি দলকে বলেছেন, র‌্যাব সন্ত্রাস দমনে ভালো কাজ করছিল। এ ব্যাপারে মার্কিন প্রতিনিধি দল র‌্যাবের যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ পাঁচটি শর্ত দিয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, একবার নিষেধাজ্ঞা জারি হলে মার্কিন প্রশাসনের জটিল নিয়মের কারণে তা প্রত্যাহার করা কঠিন।

কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলায় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বাংলাদেশ সুর নরম করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক নয় বলে কর্মকর্তারা বলছেন। পশ্চিমা দেশে (বেলজিয়াম) উচ্চশিক্ষা নেওয়া ড. হাছান মাহমুদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ সৃষ্টিসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। তাছাড়া, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক। মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেও বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তার বাহিনী এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মি উভয়ে চীনের সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তা আছে। আগামী দিনে এমন অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন হবে বিধায় নতুন মাত্রার সম্পর্কের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশের জনগণের যোগাযোগ পশ্চিমের সঙ্গেই বেশি।

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ নাকি সম্ভাবনা-এমন প্রশ্নে ঢাকার উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সেই পর্যায়ে এখনো যায়নি। এখনো ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর্যায়ে আছি। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির তিনটি দিক আছে-রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক নিয়ে কাজ করবে। বিষয়টি বাংলাদেশের নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকে উল্লেখ আছে। তবে বাংলাদেশ অবশ্যই একক কোনো বলয়ে যাবে না। ভারসাম্য রক্ষা করে চলবে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের মূলনীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না।

এদিকে, সফরকালে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিএনপি নেতা-কর্মীদের কারাগারে বন্দি থাকার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়াও, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে নাগরিক সমাজের জন্য স্পেস সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।

 

50Shares
facebook sharing button
messenger sharing button
whatsapp sharing button
twitter sharing button
linkedin sharing button
যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
Jamuna Electronics & Automobiles Ltd.