রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে রিটার্ন জমা সহজ করতে আয়কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা কমিয়ে জাতীয় সংসদে ‘আয়কর বিল-২০২৩’ পাশ হয়েছে।
নতুন আইনে করবর্ষের শেষ তারিখে ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকলে, বছরের কোনো সময়ে চিকিৎসা বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ ভ্রমণ করলে সম্পদ ও দায়ের বিবরণী জমা দেওয়া (রিটার্ন) বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে।
রোববার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাশের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিলের বিরোধিতা করে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মো. ফখরুল ইমাম, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, রওশন আরা মান্নান, ডা. রুস্তম আলী ফরাজী, কাজী ফিরোজ রশীদ এবং স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য রেজাউল করিম বাবলু। তবে তাদের সেই প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। পরে কণ্ঠভোটে বিলটি পাশ হয়।
গত ৮ জুন সংসদে উত্থাপনের পর বিলটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা নতুন আয়কর আইনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন পাশের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে বিদেশে অর্থ পাচার বৃদ্ধির পাশাপাশি খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়েছে। নতুন আয়কর কার্যকর হলে একই ঘটনা ঘটবে। মানুষের মধ্যে করভীতি বাড়বে। আইনে কর ৩৫ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ করায় দ্রব্যমূল্য বাড়বে। এ অজুহাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই হবে, বেকারত্ব বাড়বে। এনজিওগুলোর ওপর করারোপ করায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ আইনের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার স্থায়ী সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আয়কর ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে এ বিলটি আনা হয়েছে। বিলটি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। সংসদীয় কমিটিতেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এ বিল পাশ হলে সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবে। রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়বে। তাই বিলটি পাশ হওয়া দরকার।
পাশ হওয়া বিলে করযোগ্য আয় না থাকলেও দেশের সীমানা পেরোলেই ফ্ল্যাট, জমি, আসবাব, ব্যাংক ব্যালান্সসহ যাবতীয় সম্পদের তথ্য জানানো বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ট্যাক্স রিটার্নসহ তাদের সম্পদ ও দায়ের বিবরণী দাখিল করতে হবে। করদাতাদের ট্যাক্স রিটার্নে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে তাদের সম্পদ ও দায় উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
বিলে বলা হয়েছে, কোনো করদাতা যদি তার রিটার্নে বিদেশে থাকা সম্পদ প্রদর্শন না করেন, আর সেই সম্পদের খোঁজ যদি কর কর্মকর্তারা পান এবং ওই সম্পদ অর্জনের উৎস ও অন্যান্য বিষয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে জরিমানা দিতে হবে। বিদেশে থাকা সম্পত্তির ন্যায্য বাজারমূল্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা আদায়ও করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
বিলে আরও বলা হয়েছে, দেশে অবস্থানরত বিদেশিদের বাংলাদেশে তাদের সম্পদ ও দায় ট্যাক্স রিটার্নে দেখাতে হবে। স্বামী বা স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের যদি টিন নম্বর না থাকে, সে ক্ষেত্রে পরিবারের করদাতাকে তাদের সম্পদ ও আয়ের বিবরণী দাখিল করতে হবে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নতুন আয়কর আইনটি ১৯২২ সালের আয়কর আইন সংশোধন করে প্রণয়ন করা বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর স্থলাভিষিক্ত হবে। আইনে হিসাব পদ্ধতি, অবমূল্যায়ন ও মর্টাইজেশন বিধিমালা, মূলধন লাভ সম্পর্কিত বিধান, অদৃশ্য সম্পদ থেকে আয়, স্থানান্তর মূল্য ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ব্যবসায় পুনর্গঠন-মার্জার, ডিমার্জারকে ট্যাক্স নিউট্রাল করে আইনি বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা যথাসম্ভব হ্রাস করার বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে। ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজীকরণের লক্ষ্যে বিধানাবলির প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদ্যমান অধ্যাদেশের অধীন উৎসে কর কর্তন সম্পর্কিত ২১টি রিটার্ন ও বিবরণী দাখিলের পরিবর্তে প্রস্তাবিত আইনে মাত্র ১২টি রিটার্ন দাখিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।