আলোকিত স্বদেশ নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কর্মব্যস্তময় এই ঢাকা শহরে ক্লান্তি দূর করে প্রিয়জনদের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য মনোরম এক পরিবেশে গড়ে উঠেছে “হাতির ঝিল” বিনোদন প্রকল্প।একপাশে নানা সবুজ রং এর বাহারি বৃক্ষের সমাহার, অন্যপাশে ঝিলের টলটলে পানিতে ছুটে চলছে একের পর এক যাত্রীবাহী ওয়াটার বাস।পাশাপাশি রয়েছে ভ্রমণ পিপাসু যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার জন্য চক্রাকার বাস সার্ভিস।মূলত, গুলশান, বাড্ডা, তেজগাঁও, মৌচাক, কাওরান বাজার, রামপুরা, ফার্মগেট এবং মগবাজার যাওয়ার সহজ মাধ্যম হিসেবে হাতিরঝিল জায়গাটি বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।পর্যটকদের সময় কাটানোর জন্য হাতিরঝিলে স্থাপন করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পুল, বোটিং সুবিধা। এছাড়াও রয়েছে ভিউইং ডে। হাতিরঝিলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি নান্দনিক ভাসমান এম্ফিথিয়েটার। সেখানে সাংস্কৃতিক শাস্ত্রীয় আচার পালন, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাট্য-নাটিকা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এই গ্যালারিযুক্ত রঙ্গমঞ্চে প্রায় দেড় হাজার দর্শক একত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাছাড়াও এম্ফিথিয়েটারের কাছেই নির্মাণ করা হয়েছে দশতলা অত্যাধুনিক গাড়ি পার্কিং ভবন। এ ভবনে আরো রয়েছে হাতিরঝিলের প্রধান কার্যালয় ও জাদুঘর।
প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়,ঝিলটির নাম “হাতিরঝিল”ছিল না,আগে নাম ছিল”বগাবিল”।কারণ,হাজার হাজার ধবধবে সাদা বক উড়ে এসে এই ঝিলের পানিতে বিচরণ করত।দূর থেকে দেখলে মনে হত যেন,আকাশের সাদা মেঘগুলো দল বেধে নিচে নেমে এসেছে। আগে ধানমন্ডি ছিল ঢাকার বাইরে।আজকের পীলখানা তথা ধানমন্ডিতে এক সময় ছিল হাতিশালা। সেখানে যারা হাতিদের দেখাশুনা করত তাদের বলা হতো মাহুত।তখনকার সময়ে ধানমন্ডিতে প্রচুর শিয়াল ছিল । এলাকাটি ঢাকার উত্তরে ছিল বলে একে উত্তরের জাঁতা বা জঙ্গল বলা হতো।
কথিত আছে, একদিন কিছু হাতি হাতিশালার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বদিকে আসা শুরু করে এবং এক সময় হাতিগুলো বিলে চলে আসে । এই বিলের পানির উষ্ণতা হাতিদের মুগ্ধ করে। একসময় মাহুতদের একটি দল হাতিগুলোকে বগা বিলে খুঁজে পায়।বগা বিলের পানি এত পরিষ্কার ছিলো যে মাহুতেরা হাতিগুলোকে ওখানেই গোসল করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটিশ রাজার ধারাবাহিকতায় ভাওয়ালের রাজাদের পোষা হাতিগুলোও রাখা হত পিলখানায়। গোসল করানোর জন্যে হাতিগুলোকে নিয়মিত বগা বিলে নিয়ে যাওয়া হত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঢাকার পিলখানা থেকে বেগুনবাড়ি এলাকার বিলে যাওয়ার জন্য হাতিদের যেসব সড়ক দিয়ে নিয়ে যাওয়া হত পরবর্তীতে সেসব এলাকার সাথে হাতি নামটি যুক্ত হয়ে যায়। ঐ সময় এসব হাতিগুলোকে ঝিলে আনা নেওয়ার জন্যে এখনকার এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল এলাকা ব্যবহার করা হয়। হাতিদের আনা নেওয়ার কারণেই পরবর্তিতে এলাকার নামের সঙ্গে ‘হাতি’ শব্দটি যুক্ত হয়ে যায় । নিয়মিত হাতিদের স্নান করানোর কারণে বগা বিলের নাম হয়ে যায় হাতির বিল।আর সময়ের বিবর্তনে” বিল” হয়ে যায় “ঝিল”। এভাবেই”বগা বিল”থেকে “হাতিরঝিল”নামকরণ হয়।
“হাতির ঝিলে”র নকশা পরিকল্পনা করেন স্থপতি এহসান।এক সময় টলমলে সুন্দর পানির আধার থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় হাতির ঝিল পরিনত হয় নর্দমায় আর বস্তিবাসীদের থাকার জায়গায়। এর পরেই শুরু হয় সমাজের বিত্তবান ক্ষমতাশীল লোকদের জমি দখল করার প্রতিযোগীতা। যার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হল বিজিএমইএ ভবন।অন্ধ ডোবা হাতিরঝিলকে ঘিরে বাড়ছিল অপরাধমূলক কর্মকান্ড।পরিণত হয়েছিল মাদকসেবীদের আস্তানায়।ফলশ্রুতিতে জমি দখল সহ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য্য বাড়াতে সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন’ (এসডব্লিউও)এর তত্ত্বাবধায়নে পাঁচ বছরে হাতিরঝিলকে শহরের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। সৌন্দর্য্য
প্রকল্পটি ২০০৭ সালের অক্টোবরে একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। ৩ বছর মেয়াদের এ প্রকল্পটি প্রথমে ২০১০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরবর্তীতে প্রকল্পটি সংশোধন করে আরো দেড় বছর সময় ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়। প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজউকের ১ হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ, এলজিইডির ২৭৬ কোটি এবং ঢাকা ওয়াসার ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা রয়েছে। হাতিরঝিল প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের (এডরা) ‘পরিসর পরিকল্পনা’ ক্যাটাগরিতে ‘গ্রেট প্লেস অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ লাভ করে। নগর পরিবেশ আর গণপরিসর সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে এটি একটি আন্তর্জাতিক সম্মাননা।
দিনের বেলায় ঝিলের রূপ একরকম,আর রাত নামার সংগে সংগেই হাতিরঝিলের রূপ পাল্টে যায়।সে এক চোখ ধাঁধানো রূপ। ব্যস্ত নগরীতে হাফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে অবকাশের টানে রাতে সেখানে ছুটে আসেন বিনোদনপ্রেমীরা। হাতিরঝিলে রাতে আলোকসজ্জার সংযোজন আরও বেশি আকর্ষণ বাড়িয়েছে। রংবেরঙের এ আলোর সঙ্গে আছে পানির ফোয়ারা। সঙ্গে আছে মিউজিকের তাল। যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে ফোয়ারাগুলো। তখন অনেকটা শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ছবির মতোই অপরূপ দৃশ্য তৈরি হয়। যা দেখে রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যায় বিনোদনপ্রেমীরা। ইট-কাঠ-পাথরের এই শহরে গাড়ির যানজটে প্রতিদিনের ব্যস্ততায় জীবন যখন অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন সেই ক্লান্তি ও কষ্ট কমাতে অনেকেই হাতিরঝিলে ঘুরতে ছুটির দিনটাকে বেছে নেন বেশি। হাতিরঝিলে পানির ফোয়ারায় গান-নাচ শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টায়। একটানা চলে ১৫ মিনিট। ৫ মিনিটের বিরতিতে তা দর্শকদের আনন্দ দেয় রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। এ আনন্দ-সুখ অনুভূতির জন্য তরুণ-তরুণীদের ভিড় থাকে বেশি। সব মিলিয়ে ভিন্নধর্মী একটা সৌন্দর্য্য এর মেলবন্ধন তিলোত্তমা ঢাকার “হাতিরঝিল”বিনোদন কেন্দ্র।
কিন্তু রতের বেলায় হাতিরঝিল বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, কখনও ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা,আবার কখনও ছিনতাই।হাতিরঝিলের মত সুন্দর এই সড়কে কেন প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটার পেছনে খুঁজে পাওয়া গেছে ছয়টি কারণ। এক. ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। দুই. সড়কের বাঁকেও গাড়ির গতি না কমানো। তিন. রাতে গাড়ি ও মোটরসাইকেল রেস। চার. উল্টোপথে গাড়ি চালানো। পাঁচ. রাতের আলো-আঁধারে সড়কে গাড়ি পার্কিং। ছয়. ছিনতাই চক্র। তার ধারাবাহিকতায় গত ৬জুন রাজধানীর হাতিরঝিলের পাড় থেকে বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন ডিবিসি নিউজের একজন গণমাধ্যমকর্মীর গলা ও পেট কাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ৷ নিহত ২৮ বছর বয়সি আব্দুল বারি ডিবিসি নিউজের প্রডিউসার ছিলেন৷ বুধবার সকাল ৭টার দিকে পুলিশ প্লাজার উল্টো দিকে লেকের ধারের সড়কে বারির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।এর আগেও গভীর রাতে হাতিরঝিলে রহস্যজনক মৃত্যু হয় দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হাবীব রহমানের। ২৫ ফেব্রুয়ারি আসমা বেগম নামের এক নারীর ভাসমান লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত বছরের ১৫ জানুয়ারি হাত-পা বাঁধা এক যুবকের লাশ ভেসে ওঠে হাতিরঝিলে।বিগত ৯ বছরে হাতিরঝিলে ২০খুন,শতাধিক দুর্ঘটনার ঘটনা সংঘঠিত হয়েছে।পুলিশ এখন ও এই সমস্ত ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
রাজধানীবাসীর পছন্দের বিনোদনকেন্দ্রটি রাতে সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ কিছুদিন তৎপর থাকে। তবে রাতে নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই।এই সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।তাই কতৃপক্ষকে আরও সতর্ক হতে হবে।পুরো হাতিরঝিল এলাকা সিসি টিভির নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।