সর্বোচ্চ আদালতের উভয় বিভাগের (আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ) রায় ও আদেশের পুরোপুরি বাস্তবায়ন নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায় ও আদেশ বাস্তবায়নে ভবিষ্যতে নির্বাহী ও বিচারিক এবং সব কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
‘মো. নুরুন্নবী ভূঁইয়া ও চারজন বনাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী এবং অন্য’-এমন শিরোনামে আদালত অবমাননার পৃথক আবেদনের একসঙ্গে দেওয়া রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ও কারা মহাপরিদর্শকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে করা পৃথক পাঁচটি আবেদন নিষ্পত্তি করে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রায় দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ।
বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। আট পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি ২৩ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে সতর্ক করে দিচ্ছি যে ভবিষ্যতে শুধু বর্তমান অবমাননার-বিবাদীরা (সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ও কারা মহাপরিদর্শক) নয়, নির্বাহী ও বিচারিক এবং প্রজাতন্ত্রের সব কর্তৃপক্ষকে সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের রায় ও আদেশের পুরোপুরি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সতর্ক থাকতে হবে।’
রায়ে আদালত বলেন, ‘এটি বিস্মিত করে যখন আমরা দেখেছি যে দেশের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর অবমাননার-বিবাদীরা (সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ও কারা মহাপরিদর্শক) তা বাস্তবায়ন না করে নীরব ছিলেন। আদালত অবমাননার কার্যক্রম শুরু না করা পর্যন্ত তারা এই আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করতে খুব অনীহা দেখিয়েছেন। এ ধরনের প্রবণতা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যাই হোক, অবশেষে তারা এই বিভাগের (আপিল বিভাগের) সিদ্ধান্ত বিলম্বিতভাবে বাস্তবায়ন করেছেন এবং নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করে আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতির প্রার্থনা করেছেন।’
এই পর্যবেক্ষণের আলোকে আবেদনগুলো (আদালত অবমাননার অভিযোগে করা) নিষ্পত্তি করা হলো বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন আপিল বিভাগ। আদালত বলেছেন,
অবমাননার-বিবাদীদের (সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ও কারা মহাপরিদর্শক) আদালত অবমাননার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
আইনজীবীর তথ্যমতে, ছয় কর্মকর্তা ২০০৮ সালে জেল সুপারের চলতি দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৪ সালের নিয়োগবিধি অনুসারে পূর্ণ নিয়োগ পেতে তথা পদোন্নতির জন্য ২০১৬ সালে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে বিফল হন। এ নিয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে তাদের পক্ষে রায় পান। এর বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ আপিল ট্রাইব্যুনালে গেলে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। এর বিরুদ্ধে তারা আপিল বিভাগে আপিল করেন, যা ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল খারিজ হয়। আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ছয় কর্মকর্তা ২০১৯ সালে ছয়টি আবেদন (রিভিউ) করেন।
জানা যায়, পদোন্নতি নিয়ে ছয় কারা কর্মকর্তার (জেল সুপার) করা পুনর্বিবেচনার আবেদনের (রিভিউ) ওপর ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল আপিল বিভাগ রায় দেন। রায়ে ১৯৮৪ সালের অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ (ডিপার্টমেন্ট অব প্রিজন্স) রিক্রুটমেন্ট বিধিমালার আলোকে দ্রুত আবেদনকারীদের (ছয় জেল সুপার, চলতি দায়িত্ব) পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনা করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় আদালত অবমাননার অভিযোগে পদোন্নতিপ্রত্যাশী মো. নুরুন্নবী ভূঁইয়াসহ পাঁচ কর্মকর্তা ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পৃথক পাঁচটি আবেদন করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ও কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম আনিসুল হকের বিরুদ্ধে এই আবেদনগুলো করা হয়।
পৃথক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর আপিল বিভাগ পদোন্নতিসংক্রান্ত রায় বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ও কারা মহাপরিদর্শককে আদালতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেন। ধার্য তারিখ গত বছরের ৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী ও কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএসএম আনিসুল হক আদালতে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেদিন আদালত তাদের ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেন। একই সঙ্গে পুরোপুরি রায় বাস্তবায়ন বিষয়ে জানাতে বলে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি শুনানির জন্য দিন রাখেন। সেদিন শুনানি নিয়ে ওই রায় দেন আপিল বিভাগ।
পূর্ণাঙ্গ রায়টি ২৩ এপ্রিল হাতে পেয়েছেন বলেন জানান পাঁচ কারা কর্মকর্তার আইনজীবী ইব্রাহীম খলিল। শনিবার তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আপিল বিভাগের রায় অনুসারে প্রথমে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ছয় কর্মকর্তাকে কারা তত্ত্বাবধায়ক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরে পাঁচজনকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে সিনিয়র জেল সুপার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে চারজনকে কারা উপমহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ছয়জনের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রয়েছে। তাই এই দুজনের মধ্যে একজনকে সিনিয়র জেল সুপার থেকে কারা উপমহাপরিদর্শক পদে এবং অপর একজনকে জেল সুপার থেকে সিনিয়র জেল সুপার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।