অবশেষে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ঋণখেলাপিদের ধরতে সম্প্রতি সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। বিশেষ বার্তা পেয়েই গভর্নরও কড়া বার্তা দিয়েছেন খেলাপিদের।
এরপর ঋণখেলাপিদের ধরতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) প্রথমবারের মতো একটি বিশেষ টিম গঠন করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
উচ্চ ঋণখেলাপিতে এক রকম বিপর্যস্ত দেশের ব্যাংক খাত। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ ক্ষমতার জোরে ঋণ পরিশোধ করছেন না। উলটো ব্যাংকের ওপর ছড়ি ঘোরান। এসব ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংক খাত ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
খেলাপি নিয়ে দেশি সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) বিভিন্ন সময় উদ্বেগ জানিয়েছে। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে কড়া বার্তা এলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে খেলাপিও একটি। খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।
সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিও করা হয়েছে। তবে এবার একটু কড়াকড়ি করা হবে। এ নিয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় কড়া বার্তা দিয়েছেন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে গভর্নরের নির্দেশে একটি বিশেষ টিম গঠন করেছে বিআরপিডি। এ টিম খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কতজন এবং কারা টিমে আছেন-সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ধরতে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণখেলাপিদের আর ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। যদি এ ধরনের কোনো টিম গঠন করে থাকে তাহলে সেটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। টিম চাইলে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারে। সেটি আরও ভালো হবে। তবে ঋণখেলাপিদের নিয়ে কাজ করে টিম কি পেল তা যেন জনসম্মুখে প্রকাশ পায়, সে অনুরোধও করেন তিনি।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, নতুন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় তিনি বড় বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কি উদ্যোগ নেন। এখনো মন্তব্য করার সময় আসেনি। তবে কঠোর সিদ্ধান্ত ছাড়া খেলাপি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো পথ নেই বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন সরকার গঠনের পরপরই খেলাপি ঋণ আদায়ে বিশেষ নির্দেশনা পান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এরপর তিনি বিআরপিডিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে বিস্তারিত তথ্য ও আদায় পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেন।
এমনকি ১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়ও গভর্নর খেলাপিদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি বার্তা উচ্চারণ করেন। সবশেষ বৃহস্পতিবারও তিনি সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে মুদ্রানীতি, খেলাপি ঋণ আদায়, ডলার ব্যবস্থাপনাসহ সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে কথা হয়। রোববার অডিট কমিটির বৈঠকে খেলাপিসহ ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উঠে আসতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে খেলাপি ঋণের আনুষ্ঠানিক অঙ্ক ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। (যদিও অনানুষ্ঠানিক খেলাপি ঋণের অঙ্ক সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার কম হবে না বলে কেউ কেউ মত দিয়েছেন) গড় খেলাপির হার প্রায় ১০ শতাংশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে সরকারি ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংকের খেলাপির হার প্রায় ২২ শতাংশ। আবার খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ খেলাপিদের কাছে মোট অনাদায়ি অর্থের অঙ্ক প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। যদিও আন্তর্জাতিকমানে সহনীয় খেলাপির হার ৩ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শাস্তি হয় না বলেই শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে অর্থ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা বেশি। তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা হলেও দীর্ঘসূত্রতায় অর্থ আটকা থাকে বছরের পর বছর। আবার সরকারের পক্ষ থেকেও ঋণখেলাপিদের বারবার সুবিধা দেওয়া হয়। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে না গেলে খেলাপি ঋণ কমবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আশঙ্কাজনক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।
আবার তাদের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য খেলাপি ঋণ অর্ধেকের নিচে নামাতে শর্ত জুড়ে দিয়েছে। খেলাপি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এটা এত সহজ নয়। এজন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের পাঠানোর সবুজ সংকেত দরকার। আর খেলাপিদের বিষয়ে গভর্নরের কড়া হুঁশিয়ারি থেকে সবুজ সংকেতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৩টি ব্যাংকই উচ্চ খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে রয়েছে। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৬৫ শতাংশই রয়েছে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে। খেলাপি ঋণে শীর্ষ ৫ ব্যাংকের কাছে রয়েছে মোট খেলাপির ৪৮ শতাংশ।
জাতীয় সংসদে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির মোট ঋণের অঙ্ক ২১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ১৭ হাজার কোটি টাকা। ২০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলেও মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ।