বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্কের বাঁকবদল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে গত দু-এক বছরে ব্যবসা ও বিনিয়োগ, বিশেষ করে সমরাস্ত্র খাতে সহযোগিতায় বিশেষভাবে মনোযোগী হয়েছে তুরস্ক। করোনা সংক্রমণকালে গত বছরের ডিসেম্বরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলিত সাভাসগলু বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের কাছে তুরস্কের সমরাস্ত্র বিক্রির আগ্রহের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তার কথা জানান তিনি। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জুনে আঙ্কারায় দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত কেনাকাটা শুরু হয়েছে।

গত মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ আট দিনের সরকারি সফরে তুরস্কে যান। এ সময় দুই দেশের সহযোগিতার অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বলে জানা যায়।

তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলিত সাভাসগলু আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আবার ঢাকায় আসছেন। তাঁর আসন্ন ঢাকা সফরে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে।

তুরস্কের দৈনিক আল সাবাহর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কাছে ইস্তাম্বুল ক্লাসের ফ্রিগেট বিক্রিতে আগ্রহী আঙ্কারা। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে

বাঁকবদলের দুই উপাদান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
ছবি: রয়টার্স

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে ঊর্ধ্বমুখিতা, তা পাঁচ থেকে সাত বছর আগে ভাবা যেত না। বিশেষ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে সামনে এনে বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্ক সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি করেছিল। এই বিচারের প্রকাশ্য বিরোধিতা, বিচারে সরাসরি হস্তক্ষেপ, ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ সময় বাংলাদেশ সংযত থেকেছে।

তৎকালীন দায়িত্বে থাকা এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, তুরস্কের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের পর্বে বাংলাদেশ কখনো ‘ইটের বদলে পাটকেল’ নীতিতে হাঁটেনি। বরং বরাবর সংযত থেকেছে। কাছাকাছি সময়ের দুটি ঘটনা দুদেশের সম্পর্কের বাঁকবদলে বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রথমটি হলো, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি। দ্বিতীয়টি, ২০১৭ সালের আগস্টের রোহিঙ্গাঢলের পর সেপ্টেম্বরে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ানের বাংলাদেশ সফরে এসে কক্সবাজারের শিবির পরিদর্শন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে তুরস্ক যে বৈরী আচরণ করেছিল, সেটিকে সামনে না এনে ঐতিহাসিকভাবে আঙ্কারার সঙ্গে ঢাকা যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে মনোযোগী, সেটির প্রমাণ তারা পেয়েছিল সেদেশে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই শেখ হাসিনার বার্তায়। তাই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে তুরস্ক সম্পর্কোন্নয়নের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে কাজে লাগায়। তারই ধারাবাহিকতায় তুরস্কের তখনকার প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বাংলাদেশ সফর করেন।

ডিসেম্বর ২০১২: পরিচয় গোপন করে তুরস্কের এনজিও প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর।
ডিসেম্বর ২০১২: গোলাম আযমসহ জামায়াত নেতাদের ফাঁসি বন্ধে তুরস্কের চিঠি।
মে ২০১৬: নিজামীর ফাঁসির পর তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে সাময়িক প্রত্যাহার, ঢাকার পাল্টা পদক্ষেপ।
জুলাই ২০১৬: তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ানকে সমর্থন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি।
আগস্ট ২০১৭: রোহিঙ্গাঢলের পর তুরস্কের ফার্স্ট লেডির কক্সবাজার সফর।
সেপ্টেম্বর ২০২০: আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্বোধনের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তুরস্ক সফর।
ডিসেম্বর ২০২০: ঢাকায় এসে বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রির ঘোষণা তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
জুন ২০২১: বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রির জন্য তুরস্কের প্রতিরক্ষা চুক্তি সই।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) ফেলো অধ্যাপক মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ঘিরে এই সম্পর্কে তিক্ততা শুরু করেছিল তুরস্ক। তবে বাংলাদেশ সতর্ক থেকেছে। সেই সঙ্গে বাস্তববাদীও। এই বিষয়টি তুরস্কও পরে বুঝতে পারে। ফলে তারা এখন সম্পর্কোন্নয়নে জোর দিচ্ছে।

তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান বাংলাদেশ সফরে এসে কক্সবাজারের শিবির পরিদর্শন করেন

তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান বাংলাদেশ সফরে এসে কক্সবাজারের শিবির পরিদর্শন করেন
ফাইল ছবি

পররাষ্ট্রনীতির নতুন অগ্রাধিকার

ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার প্রেক্ষাপটে এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে তুরস্ক। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ‘এশিয়া এনিউ’ উদ্যোগের মাধ্যমে তুরস্ক এই কাজটি করছে। উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, বেসরকারি খাতের ব্যবসার সামর্থ্য বাড়ানো, শিক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়ানো ও এশিয়ার দেশগুলোর সমাজের বিভিন্ন স্তরের যোগাযোগ বৃদ্ধি—এই চারটি ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হচ্ছে।

আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্বোধনের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তুরস্ক সফর করেন

আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্বোধনের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তুরস্ক সফর করেন
ফাইল ছবি

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি পরস্পর স্বার্থসংশ্লিষ্ট। দুই দেশের সম্পর্কে চড়াই-উতরাই তো ছিলই। কিন্তু আমাদের সংবেদনশীলতার গুরুত্ব তারা বুঝতে পেরেছে। তাদের অবস্থানও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ওআইসিতে সৌদি আরবের বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বিষয়ে আঙ্কারার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এটা ঠিক যে রোহিঙ্গা সংকট দুই দেশকে অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সেটাকে উপজীব্য করে সমরাস্ত্র উৎপাদনকারী হিসেবে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতায়, বিশেষ করে আধুনিক সমরাস্ত্র বিক্রিতে জোর দিচ্ছে। আবার দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের উজ্জ্বল ও ভারসাম্যমূলক অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে তারা সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী হয়েছে।’